ঢাকাঃ জুলিয়াস অবি চেয়ারে বসে একদৃষ্টে তার টাইপ রাইটারটির দিকে তাকিয়ে আছে। তার বস মোটাসোটা প্রধান কেরানিটি টেবিলে মাথা রেখে ইতিমধ্যেই নাকডাকা শুরু করে দিয়েছে। বাইরে, সবুজ রঙের উর্দি পরা দারোয়ান চৌকিতে ঘুমিয়ে আছে। বিগত প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে কোনো ক্রেতা ফটকের ভেতর দিয়ে ঢোকেনি। ওজন মাপার বিশাল যন্ত্রটির উপরে একটি খালি ঝুড়ি ফেলে রাখা। কয়েকটা পাম শাঁস যন্ত্রটির চারপাশে ধুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জুলিয়াস উঠে জানালাটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় যেখান থেকে নাইজার নদীর পাড়ে বিশাল বাজারটি চোখে পড়ে। অন্য সব ইবো বাজারের মত এই বাজারটি সপ্তাহে চারটি বাজার দিনের মধ্যে একদিন বসত। তবে সাদাদের আগমন এবং উমুরু নদী ঘাঁটটি একটি বিশাল পাম-ওয়েল বন্দরে পরিণত হওয়াতে এটা এখন একটা প্রাত্যহিক বাজারে পরিণত হয়েছে।
এসব সত্ত্বেও বাজারটি এখনও এটার মূল নিকোয়া বারে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। কারণ এটার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ঐদিনই কেবল তার জাদুমন্ত্র প্রয়োগ করে। লোকমুখে শোনা যায় যে দেবী একজন লোলচর্ম পক্ককেশ বুড়ির ছদ্মবেশ ধরে ঐদিন ভোরে মোরগ ডাকার আগ মুহূর্তে বাজারের মাঝখানে এসে আবির্ভূত হয়। এবং দূর সম্পর্কীয় নানা গোত্র থেকে নারী-পুরুষকে বাজারের দিকে টেনে নিয়ে আসতে সে তার জাদুর পাখা পৃথিবীর চার অভিমুখে- তার সামনে-পেছনে, ডানে-বামে- নাড়ায়। এবং তারা আসে, এই শত শত নারী-পুরুষ বহন করে নিয়ে আসে তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য: পাম তেল ও শাঁস, কোলা বাদাম, কাসাভা, হরেক রকমের মাদুর, ঝুড়ি এবং মাটির হাড়ি-পাতিল। এবং তারা বাড়ি ফেরার সময় সাথে করে নিয়ে যায় রঙ্গীন বাহারি কাপড়চোপড়, ধূমায়িত মাছ এবং লোহার বাসন-কোসন। ডিঙ্গি নৌকায় মাছ এবং ইয়াম ভরে আরো অনেকে বিশাল নদী দিয়ে আসে।
অনেক সময় বারো চৌদ্দজন আসে বড় ডিঙ্গি নৌকায়; আবার মাঝে মাঝে একজন জেলে আর তার বউ একটা ছোট নৌকায় চড়ে খরস্রোতা আনাম্বারা নদী দিয়ে আসে। তারা ডিঙ্গি ঘাটে বেঁধে অনেক দরাদরির পর তাদের মাছ বিক্রি করে। এরপর নারীরা নদীর খাড়া পাড় বেয়ে হেঁটে বাজারের ভেতর প্রবেশ করে তেল-নুন কিনতে এবং বিক্রি-বাট্টা ভালো হলে এক ফালি কাপড়ও কিনে ফেলে। এবং বাড়িতে রেখে আসা শিশুদের জন্য কিনে ইগারা- নারীদের তৈরি মটরশুটি পিঠা অথবা “আকারা” এবং “মেই-মেই”। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে তারা বৈঠা হাতে নৌকা বাইতে শুরু করে, সূর্যাস্তের লালচে আভায় নদীর পানি চিকচিক করে এবং তাদের ডিঙ্গিগুলো তীর থেকে দূরে সরতে সরতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতে পানির উপর বাঁকা চাঁদের মত হয়ে উঠে এবং তার মধ্যে দুটি আবছা অবয়ব সামনে পেছনে দুলতে থাকে। জুলিয়াস অবি উমুরু এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা নয়।
সে এসেছে বিশ মাইলের মত দূরের জঙ্গলাকীর্ণ একটি গ্রাম থেকে। কিন্তু সে মিশন স্কুলে ১৯২০ সালে স্ট্যান্ডার্ড সিক্স পাস করার পর উমুরুতে নাইজার কোম্পানির অফিসে কেরানির কাজ নিয়ে চলে আসে, এটা পাম তেল ও পাম শাঁসের ব্যবসা করে। এই কোম্পানির অফিস বিখ্যাত উমুরু বাজারের পাশেই অবস্থিত। এর ফলে প্রথম দুই তিন সপ্তাহের মধ্যেই তাকে ব্যাপক হৈ-চৈ আর হট্টগোলের মধ্যেই কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হয়। মাঝে মাঝে যখন প্রধান কেরানিটি বাইরে যায় অথবা ঘুমিয়ে থাকে তখন সে হেঁটে জানালাটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় এবং উইঢিবির মত বিপুল কর্মযজ্ঞের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে মনে মনে ভাবে, এই ভিড়ের মধ্যকার অধিকাংশ লোক গতকাল এখানে ছিল না, তারপরও পুরো বাজার ছিল আজকের মতই জনাকীর্ণ। পৃথিবীতে নিশ্চয় অনেক মানুষের বাস।
অবশ্য তারা বলে যে এই বিশাল বাজারে যারা আসে তারা সকলেই আসল মানুষ নয়। জ্যানেটের মাও এরকম বলত। “যে সুন্দরী তরুণীদের ঠেলেঠুলে ভিড়ের ভেতর ঢুকতে দেখো, ওদের সকলে কিন্তু আসল মানুষ নয় বরঞ্চ নদী থেকে উঠে আসা ম্যাম্মি ওয়াটা, ” জ্যানেটের মা বলত। “ওদেরকে চেনা যাবে কিভাবে?” জিজ্ঞেস করে জুলিয়াস, তার শিক্ষা-দীক্ষা তাকে এসব কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। কিন্তু সে তার অবিশ্বাসী মনোভাব গোপন করার চেষ্টা করে। সে অন্তত এটুকু শিখেছে যে, এসব বিষয় নিয়ে মুরুব্বিদের সাথে তর্ক করা খুব একটা ভালো দেখায় না। “তাদেরকে সহজেই চেনা যায়, ” সে ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়াস পায়, “কারণ তাদের সৌন্দর্য এই পৃথিবীর সৌন্দর্য থেকে পুরোপুরি আলাদা ।