অবশেষে শেষ হলো পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানোর কাজ। বৃহস্পতিবার ৪১তম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে বাস্তবে রূপ স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ঠিক দুপুর ১২টায় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের ১২-১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় ‘টু-এফ’ স্প্যানটিকে। তবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের পেছনে রয়েছে বহু চ্যালেঞ্জের গল্প। সেতুর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন শ্রাবস্তি রোম্মান (Shrabosty Romman)।
তার লেখাটি প্রকাশ করেছে বিডি এলার্ট ( BD Alert) নামে একটি ফেসবুক পেজ।
বিডি এলার্ট পেজের সৌজন্যে একটিভ নিউজের পাঠকের জন্য লেখাটি তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশের খুব কম মানুষ আছে, যে পদ্মা সামনা সামনি দেখেনি। আপনি পদ্মাকে দেখলে, কী দেখেন? এর প্রস্থ? অবশ্যই প্রস্থ। কারণ গভীরতা, স্রোতের বিশালতা এত সহজে বোঝা যায় না।
নদীর গভীরতা কত জানেন? পানির প্রায় চল্লিশ মিটার নিচে নদীর তলদেশ। চল্লিশ মিটার মানে ১৩১ ফিট প্রায়। দশ ফিট করে সাধারণত এক তালার উচ্চতা। সেই হিসাবে পদ্মা নদীর তলদেশ থেকে পানির পৃষ্ঠের উচ্চতা হল ১৩ তলা বিল্ডিংয়ের সমান।
আরো পড়ুন: স্প্যান বসানোর কাজ শেষ, যেদিন থেকে শুরু হচ্ছে গাড়ি চলাচল
তাহলে ব্রিজের কলামগুলো (যেগুলোকে আসলে সিভিল ভাষায় পিয়ার বলে) ১৩তলা বিল্ডিংয়ের সমান হতে হবে।
কিন্তু কলাম যদি মাটিতে গাঁথা না থাকে, পদ্মার যে স্রোত, কলাম তো ভেসে চলে যাবে। কী মনে হয়, ১৩ তলার সমান লম্বা কলাম ভেসে যাবে না? যাবে ভাই। এটা পদ্মা। তো কলাম মাটিতে গেঁথে দিতে হবে। কতটুকু গাঁথবেন? পদ্মার তলদেশের মাটি হল বালি টাইপের, নরম কাদা টাইপ।
পাথরের মতো শক্ত না। বেডরক প্রায় ৮কি.মি নিচে বলে ধারণা করা হয়। ৮কি.মি হল মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা! তো বেডরক পর্যন্ত যাওয়ার স্বপ্ন না দেখাই ভালো। অনেক দেশেই বেডরক অনেক অল্প নিচেই পাওয়া যায়। তাদের দেশে যে কোনো স্ট্রাকচার বানানো অনেক কম খরচের ব্যাপার কারণ তাদের ফাউন্ডেশন বানানো অনেক সহজ, খরচও কম।
আমাদের এদিক দিয়ে কপাল খারাপ।
যাইহোক, তাহলে পদ্মা নদীর ব্রিজের পাইল কতটুকু দিতে হবে?
বর্ষাকালে যখন অতিরিক্ত স্রোত থাকে, এই পদ্মার তলদেশের বালির মতো মাটি, ধুয়ে চলে যায়। এটাকে স্কাওয়ার (scour) হওয়া বলে। পদ্মা নদীর স্কাওয়ার হওয়ার সর্বোচ্চ রেকর্ড হল ৬৫ মিটার (প্রায়) (বা ৬১ মিটার)। মানে নদীর নিচ থেকে ৬৫ মিটার মাটি ধুয়ে চলে গেছে।
মানে ২১৩ ফিট। মানে ২১তলা বিল্ডিংয়ের সমান হাইটের মাটি ধুয়ে চলে গেছে। পদ্মার এই প্রায় ২১ তলার সমান মাটি ধুয়ে চলে যাবার রেকর্ড বা এত বেশি পরিমাণ সেডিমেন্ট (মাটির কণা) ট্রান্সপোর্ট করার রেকর্ড অন্য কোনো নদীর নেই। এ অবস্থায় পানির নিচে মাটি পেতে হলে আপনাকে নিচে নামতে হবে ১৩+২১=৩৪ তলা! তাহলে আপনাকে ব্রিজের যে কলামগুলো দিতে হবে, সেগুলোকে ৪০+৬৫=১০৫ মিটারের বেশি লম্বা হতে হবে! মানে ৩৪তলা বিল্ডিংয়ের চেয়ে লম্বা কলাম!
এখন নদীর কোন জায়গায় স্কাওয়ার বেশি হয়, কোথাও কম হয়। আপনি নিশ্চিত নন, কোথায় কতটুকু স্কোওয়ার হয়ে আপনার সাধের পদ্মা ব্রিজের কলাম বের হয়ে যাবে (exposed হবে), মাটিতে গেঁথে থাকবে না, ফলাফল হিসেবে আপনার এত সাধের লম্বা কলামটা ভেসে যাবে! এজন্য মোটামুটি গড়ে ১২০ মিটার পাইল দেওয়া হয়েছে।
১২০ মিটার মানে প্রায় একটা ৪০ তলা বিল্ডিং! এই ৪০তলা বিল্ডিংয়ের সমান লম্বা পাইল, বসানো হয়েছে। ১২০ মিটার কথাটা প্রথমে শুনে ভেবেছিলাম ভুল শুনেছি, ১২০ ফিট নিশ্চয় হবে। পরে আরও অনেক বার শোনার পর বুঝলাম, ১২০ ফিট না, মিটার!
এটা গেল পাইলের গভীরতা! এবার চলেন দেখি পাইলের সাইজ কেমন, আকার কেমন। পাইলগুলো গোল। গোল ৪০তলা বিল্ডিংয়ের সমান লম্বা সিলিন্ডার! এ সিলিন্ডারের ব্যাস হল ৩ মিটার।
মানে প্রায় আপনার রুমের ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত! এটা হল ব্যাস! পাইলগুলো বানানো হয় স্টিলের পাত দিয়ে। বেশ পুরু এই পাতগুলোকে মুড়িয়ে সিলিন্ডার বানানো হয়। এই সিলিন্ডার জ্যামিতিক হারে অ্যাটাচ করা হয়। মানে এক মিটার লম্বা সিলিন্ডারের সাথে, এক মিটার লম্বা আর একটা পার্ট। এবার এই দুই মিটার লম্বা সিলিন্ডারটার সাথে, আর এক একটা দুই মিটার লম্বা সিলিন্ডার।
এভাবে ২০তলা বিল্ডিংয়ের সমান লম্বা একটার সাথে আর একটা ২০ তলার সমান লম্বা পাইল জোড়া দিয়ে বানানো হয় একটা পাইল!
আরো পড়ুন: কত হচ্ছে পদ্মা সেতুর টোল ফি?
এই যে বিশাল লম্বা পাইলগুলো, আপনার কি মনে হয়, কে ধরে তুলে নিয়ে গেছে? কে বসালো এগুলো? সুপারম্যান? এই পাইলগুলোর জন্যই জার্মানি থেকে স্পেশাল হ্যামার (হাতুড়ি) আনা হয়েছে। একটা হ্যামার তো পদ্মা সেতুর জন্যই বানানো হয়েছে, এমন শুনেছিলাম। স্পেশাল ক্রেন, স্পেশাল হ্যামার! এলাহি কাণ্ড মাওয়া-জাজিরায়।
এ পাইলগুলো ফাঁপা। মাটিতে বসানোর পর, এদের মাঝে বালি দিয়ে ফিল করা হয়।
পাইলগুলোতে জং ধরতে পারে। যদি বা ধরে ১০০ বছরে ক্ষয় হবে ১০ মিলিমিটার। ৫০ থেকে ৬০ মিলিমিটার তখনো থাকবে। (এটা টেস্টেড, কতটুকু ক্ষয় হবে জং ধরলে) পদ্মা সেতুর ডিজাইন লাইফ ১০০ বছর। মানে ১০০ বছরে পাইলের থিকনেস কমা ছাড়া অন্য কিছু হবে না।
এই পাইলগুলোকে আসলে কাইসন (caisson) বলে।
এটা একটা পাইলের কাহিনী! কি মনে হয় আমাদের সাধের পদ্মা ব্রিজের কলাম, যাকে আমরা পিয়ার বলি, এই একটা পাইলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে? যদি এই পাইলের নিচের মাটি সরে যায়? যদি পাইল ভেঙে টেঙে যায়! এ জন্য প্রতি কলামের নিচে ৬টা করে পাইল থাকবে। মাকড়শার যেমন ৮টা পা ৮দিকে থাকে, এই পিয়ারের (কলামের) পাইলগুলো তেমন ৬ দিকে ছড়িয়ে যাবে। পাইলগুলো খাড়াভাবে কিন্তু মাটিতে বসানো হয় না। বাঁকা করে, ইনক্লাইন্ডভাবে বসানো হয়।
1H:6V অনুপাতে ইনক্লাইন্ড হয়। তো ১২০ মিটার লম্বা পাইল, বাঁকা করে ঢোকালে মাটির নিচে এদের ৬ জনের পা, ৬ দিকে অনেক অনেক দূরে থাকবে। এই ৬ দিকের মাটি একসাথে ধুয়ে যাবে না।
এই যে এরা ইনক্লাইন্ডভাবে থাকবে, এতে এদের লোড নেওয়ার ক্ষমতাও একটু বাড়বে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, ঘূর্ণিঝড়ের সময় যে সাংবাদিকরা রিপোর্ট করেন, দেখা যায় দুই পা দুই দিকে, দূরে দিয়ে আছেন।
সোজা দাঁড়ানো থাকলে বাতাসে উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনটা করেন কারণ যে ল্যাটারাল লোডটা আসে (বাতাসের চাপ) সেটা দুইপা একসাথে করে দাঁড়ালে যতটা সহজে দাঁড়ানো যায়, দুইপা দুদিকে দিয়ে রাখলে দাঁড়াতে সুবিধা হয়, লোড সহ্য করা যায় বেশি। এটাও কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান। তো, এই ৬টা পাইলও শুধু ইনক্লাইন্ড থাকার জন্য ল্যাটারাল লোড নেবে বেশি। (ল্যাটারাল লোড মানে যেটা সাইড থেকে আসছে, যেমন স্রোতের যে ধাক্কাটা, সেটা)।
আবার শুধু ইনক্লাইন্ড হওয়ার কারণেই ১২০মিটার দৈর্ঘের পাইল, মাটির নিচে যাবে ১১৮.৩ মিটার। কারণ যখন কোনো লাঠি বাঁকিয়ে ফেলি, তখন তার দৈর্ঘ্য একই থাকলেও তার উচ্চতা কমে যায়। যেমন মই যদি খাঁড়া দেওয়ালে লাগিয়ে রাখি, তাহলে যত উঁচুতে মইয়ের মাথা থাকবে, মই হেলিয়ে দিলে মইয়ের মাথা আরও নিচে নেমে যাবে। পাইলের ব্যাপারটাও এমনই। এই পাইলগুলো ডিজাইন করার সময় PIGLET নামে প্রোগ্রাম ব্যবহার করা হয়।
সর্বোত্তম পাইল খুঁজে বের করা হয়েছে এই প্রোগ্রাম দিয়ে। তিন ধরনের পাইল ফাউন্ডেশনের ওপর এই স্ট্যাডি করা হয়।
এই তিন ধরনের ফাউন্ডেশন হলো:
১. 6 raking steel tubular piles
২. 8 raking steel tubular piles
৩. 12 cast in situ vertical concrete pile
গবেষণায় দেখা যায়, ৬টা ইনক্লাইন্ড স্টিল পাইলের ফাউন্ডেশন সবচেয়ে কার্যকর. ( raking মানে ইনক্লাইন্ড) এই ৬টা পাইলের মাথায় থাকবে পাইল ক্যাপ। এই জিনিসটা আপনি পানিতে ভেসে থাকতে দেখবেন। কিন্তু এটা মোটেও ভেসে নেই! এটা রীতিমতো ৬ পা (পাইল) দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এই পাইল ক্যাপ এত বড়, একটা ৩/৪ জনের ফ্যামিলি এতটুকু জায়গায় সংসার করতে পারবে! একটা খুবই রাফ এস্টিমেসন বলে, এখানে ৯০০ স্কয়ার ফিটের বেশি জায়গা আছে! মানে একটা পাইল ক্যাপ ৯০০ স্কয়ার ফিটের চেয়ে বড়। এই পাইল ক্যাপ পুরোটাই পাথরের।
আরো পড়ুন: অবশেষে বাস্তবে রূপ নিল স্বপ্নের পদ্মা সেতু
দুইটা পিয়ারের নিচের পাইল একটু অন্য রকম। vertical bored concrete pile। যেগুলো ৮০ মিটার পর্যন্ত গভীরে।
মানে এই পাইলগুলো ইনক্লাইন্ড না, সোজা পানির নিচে। এগুলো কংক্রিটের পাইল, আমাদের বাসাবাড়ির সাধারণ কলামের মতো। সবচেয়ে মজার অংশ হলো, এই পাইলগুলো পানিতে কাস্ট করা হয়! মানে পানির মাঝে কংক্রিট ঢেলে দেয়! কিন্তু কংক্রিট ভেসে না গিয়ে কলাম হয়ে যায়! এই প্রযুক্তিও আছে! এই পাইলের ক্ষেত্রে একটা পিয়ারের নিচে ১২টা করে পাইল দেওয়া হয়। এই পাইল ক্যাপের ওপর দাঁড়ায় পিয়ার বা ব্রিজের কলাম। এই পিয়ার পুরোটাই কংক্রিটের।
এই পিয়ারের মাথায় বসে স্প্যান। প্রতিটা স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। মানে, বলা যায় বাটা সিগনাল থেকে কাঁটাবন মোড় পর্যন্ত, দুইটা স্প্যানের দৈর্ঘ্য।
এই স্প্যান ডিজাইনের জন্য, ৩ ধরণের স্প্যানের এনালাইটিক্যাল মডেল (কম্পিউটারে এনালাইসিস সফটওয়্যার দিয়ে) বানিয়ে চেক করা হয়। কোনটা সবচেয়ে কম খরচে বেশি সেফটি দেবে।
তিনটা স্প্যান ছিল: ১২০ মিটার, ১৫০ মিটার আর ১৮০ মিটার। এদের মধ্যে ১৫০ মিটার স্প্যান ছিল সবচেয়ে কার্যকর। তাই বাস্তবে ১৫০ মিটার স্প্যান বসানো হয়েছে। সবগুলো স্প্যান মিলে হয় ৬,১৫০ মিটার। অর্থাৎ, পুরো ব্রিজের দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিমি।
মানে পুরো পদ্মা ব্রিজটা হলো- সাইন্স ল্যাব বাস স্ট্যান্ড থেকে কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ড এর সমান লম্বা বা শাহাবাগ থেকে মহাখালী ফ্লাইওভার পর্যন্ত লম্বা।
পদ্মা ব্রিজ একটা দুইতালা ব্রিজ। স্টিলের কাঠামোর মধ্য দিয়ে যাবে ট্রেন। রেল লাইন হল ডুয়েল গেজ। ফলে বোর্ড গেজ ও মিটার গেজ; দুই ধরনের রেলগাড়িই পদ্মা ব্রিজ পাড়ি দিতে পারবে।
আমাদের দেশের পশ্চিম দিকের (রংপুর রাজশাহী, কুষ্টিয়া খুলনা সাইড) রেল লাইন ব্রড গেজ। আর বাকি সারা দেশের রেল লাইন হলো মিটার গেজ। এক ধরনের রেল অন্য রেল লাইনে চলতে পারে না। কিন্তু ডুয়েল গেজ দিয়ে এই দুই ধরনের রেলই চলতে পারে। তো পদ্মা ব্রিজ দিয়ে আসলে বাংলাদেশের যে কোনো রেলই চলতে পারবে।
এখানে জরুরি ব্যবস্থা থাকবে যাতে ট্রেনে কোনো ধরনের সমস্যা হলে, ট্রেন থেকে মানুষ নামিয়ে তাদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।
আবার, এটা কোনো সাধারণ রেললাইন না। এটাতে যাতে দুটি কনটেইনার নিয়ে মালগাড়ি যেতে পারে সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে রেলগাড়ি সাধারণত একটি কনটেইনার নেয়। কিন্তু এখানে করা হচ্ছে যাতে ভবিষ্যতে একটার ওপর আরেকটি কনটেইনার অর্থাৎ দোতলা কনটেইনার নিয়ে ট্রেন যেতে পারে।
এই দোতলা কনটেইনার নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য মূল ব্রিজের লোড নেওয়ার ক্ষমতা বাড়াতে হয়েছে। সেই লোডটা আসলে নেবে প্রথমে রেললাইন, রেল থেকে ট্রাস, ট্রাস থেকে পিয়ার (কলাম), পিয়ার থেকে পাইল। এজন্য পাইলকে আরও বেশি মজবুত বানাতে হয়েছে। এবং খুবই স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবে খরচ বেড়েছে।
এই দুইতলা ব্রিজের ওপরে বসবে কংক্রিটের ডেক।
মানে ছাদ। এটার ওপর দিয়ে গাড়ি চলবে। সবচেয়ে হাল্কা যে ম্যাটেরিয়াল দিয়ে ডেক তৈরি করা সম্ভব, সেটাই ব্যবহার করা হবে। ডেক, মানে ব্রিজের ওপর রাস্তা চওড়া হবে ২২ মিটার বা ৭২ ফিট। এইখানে চার লেনে গাড়ি চলবে।
এই স্প্যান বসানোর আগে ভূমিকম্প সহনীয় পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এটা না থাকলে ভূমিকম্প যে এনার্জি নিয়ে স্ট্রাকচারকে হিট করত, এটা থাকায় সেই এনার্জি অনেকটা কমে যাবে। এখানে যে প্রযুক্তি বেজ আইসলিউশন ব্যবহার করা হয়েছে, এটাতে ভূমিকম্পের সময় ফাউন্ডেশন মুভ করবে কিন্তু ওপরের ব্রিজটা মুভ করবে না। নড়াচড়ার একটা ব্যবস্থা থাকবে। এটাকে পেনডুলাম বিয়ারিং বলে।
সেটা ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সাহায্যে স্লাইড করতে পারবে। আবার ফিরে আসবে। বিশ্বে এটা অনেক জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এত বড় প্রকল্পে কখনো ব্যবহার করা হয়নি।
এই প্রযুক্তির কারণে পাইলের সংখ্যা, পাইল ক্যাপের সাইজ কিছুটা কমানো গেছে।
ব্রিজের মাধ্যমে কিছু ইউটিলিটিসও নদী পার হবে! গ্যাস ট্রান্সমিশন লাইন থাকবে একটা। অপটিক্যাল ফাইবার ও টেলিফোনের লাইন যাবে। এবং অবশ্যই ইলেকট্রিক লাইন যাবে। এই হলো শুধু ব্রিজ।
শুধু পদ্মা ব্রিজ। কিন্তু প্রোজেক্টে আরও অনেক কিছু রয়ে গেছে, যেমন নদীশাসনের কাজ, অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ। এবার চলেন সেগুলোর দিকে তাকাই।
অ্যাপ্রোচ রোড কী সেটা একটু বলি। শুধু একটা ব্রিজ বানালেই হয় না।
সেই ব্রিজের সাথে যে রাস্তাগুলো এখন আছে, যেগুলোতে গাড়ি চলছে, সেই রাস্তার সাথে ব্রিজের সংযোগ দিতে হয়। এই সংযোগ দেওয়া রাস্তাটাই অ্যাপ্রোচ রোড। পদ্মা ব্রিজের এই অ্যাপ্রোচ রোড হল ব্রিজের দ্বিগুণ লম্বা। ১২ কি.মি.। এই অ্যাপ্রোচ রোড তৈরির কাজটা করেছে দেশীয় কোম্পানি আব্দুল মোনেম লিমিটেড।
অ্যাপ্রোচ রোডের কাজের মধ্যে ছিল জাজিরা থেকে জাতীয় সড়কের সঙ্গে সংযোগ। একইভাবে মাওয়ার কাছাকাছি যে রাস্তা ছিল সেটাকে আন্তর্জাতিক মানে আনা। আর সার্ভিস এরিয়া। যেটা এই বিশাল কন্সট্রাকসন সাইটের মেইন অফিস। নির্মাণের সময় এবং নির্মাণ শেষ হয়ে গেলে এখানে অফিস এবং বাসস্থান তৈরি করা হবে।
এর মধ্যে জাজিরা প্রান্তে যে সংযোগ সড়ক আছে, সেখানে পাঁচটা সেতু প্রয়োজন। শুধুমাত্র এই সেতুগুলোর দৈর্ঘ্য যোগ করলেই দাঁড়ায় প্রায় এক কিলোমিটার।
প্রকৌশলগত দিক থেকেও এ কাজটা কঠিন ছিল। জাজিরার রাস্তাটা মোটামুটি এক সময় চর এলাকা ছিল। নরম মাটি।
এত নরম মাটির ওপর দিয়ে রাস্তা করা সমস্যা, কারণ এতে রাস্তা জায়গায় জায়গায় ডেবে যাবে এবং ফলাফল হিসেবে ওপরে পিচের রাস্তা ভেঙে যাবে। তারপর যে কোনো রাস্তা আবার বন্যার লেভেলের অনেক ওপরে রাখতে হয়। অর্থাৎ বন্যার রেকর্ড থেকে খুঁজে বের করা হবে সবচেয়ে বেশি কতখানি পানি উঠেছিল। তারপর দেখা হবে, একটা নির্দিষ্ট সময়ে (হয়ত আগামি ১০০ বছরে) বন্যায় সর্বোচ্চ কতটুকু পানি উঠতে পারে। তারপর সেই সর্বোচ্চ উচ্চতার পানির উপরে যেন রাস্তা থাকে, সেভাবে রাস্তা বানানো হবে।
এজন্য মাটি ফেলে বাঁধের মতো উঁচু জায়গা বানানো হয়েছে। এরপর রাস্তার নিচের মাটির ঘনত্বটা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এ কাজের জন্য মেশিন আনতে হয়েছে জার্মানি থেকে। নাম হলো স্যান্ড কমপ্যাকশন পাইল। এটা প্রযুক্তিগত দিক থেকে খুব দুরূহ নয়।
নরম মাটির ভেতরে একটা পাইপের মতো ঢোকায়। ওপর থেকে একটা মেশিন দিয়ে চাপ দেওয়া হয় পাইপের ভেতরে।
পাইপের নিচেরটা বন্ধ করা থাকে। এই প্রক্রিয়ায় মাটিটা নিচে ডেবে সরে যায়। আর পাইপটা যখন তোলা হয় তখন এর ওপর থেকে বালু ফেলা হয়।
এভাবে মাটির ঘনত্ব বাড়ানো হয়েছে। এতে আশা করা যায়, যখন কোনো যানবাহন চলাচল করবে, তখন এই রাস্তা ডেবে যাবে না। বহু পরীক্ষা করা হয়েছে। গাড়িও চলছে, কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে না। এই অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ শেষ।
পদ্মা ব্রিজ বানানোর জন্য দুই বিশাল কন্সট্রাকসন ইয়ার্ড বানাতে হয়েছে মাওয়া আর জাজিরা, দুই প্রান্তে। পুরো কন্সট্রাকসন ইয়ার্ড হেঁটে ঘুরে দেখলে যে সারাদিন লেগে যাবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এই বিশাল কন্সট্রাকসন ইয়ার্ড আর অ্যাপ্রোচ রোডের জন্য, বিশাল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। ১৩,০০০ বাড়ি যেখানে প্রায় ৭৪,০০০ মানুষ বসবাস করত, এই প্রোজেক্টের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব মানুষদের জন্য সাতটা রিসেটেলমেন্ট এরিয়া বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে নদীর দুই ধারে।
সেখানে তাদের ঘরবাড়ি, মসজিদ, স্কুল, বাজার এগুলো সবই বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পদ্মা নদীর আশেপাশের অনেক গাছ কাটা পড়েছে এই কন্সট্রাকসন ইয়ার্ড, অ্যাপ্রোচ রোড, রিসেটেলমেন্ট এরিয়া আর সার্ভিস এরিয়ার জন্য। এজন্য বনায়নও করা হয়েছে। ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত ৭০,৪৫২টি গাছ লাগানো হয়েছিল। এই দায়িত্ব ছিল বনবিভাগের।
পদ্মা ব্রিজের আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল নদীশাসনের কাজ। চলুন প্রথমে দেখি, নদীশাসনটা আসলে কী, কেন দরকার। নদী ভাঙে গড়ে। নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এখন ব্রিজটা থাকল মাওয়া জাজিরায়, নদী হয়তো গতিপথ পাল্টায়ে অন্য কোথাও চলে গেল।
তখন এত সাধের পদ্মা ব্রিজ হয়ে যাবে জামালপুরের ভাঙা ব্রিজের মতো। (জামালপুরে নাকি ভাঙা ব্রিজ নামে একটা ব্রিজ আছে, যেখানে নদীর কিনার ভেঙে নদী সরে গেছে, কিন্তু ব্রিজটা আগের জায়গায় থেকে গেছে।) তো পদ্মা ব্রিজের দুই পাশে যাতে কিনার থাকে, আর সেই কিনারে যাতে অ্যাপ্রোচ রোড থাকে; যাতে গাড়ি ব্রিজ থেকে নেমে চলার রাস্তা পায়, এজন্যই নদীশাসনের কাজটা করা হচ্ছে।
নদীশাসনটা কী?
নদীশাসন বলতে বোঝায়, নদীর গতিপথ ও কিনারা রক্ষার জন্য যে স্ট্রাকচারাল কাজ করা হয়। কিনার বাঁচানোর জন্য যখন ইট পাথর বা এই জাতীয় জিনিস ব্যবহার করা হয় বা যেকোনো কিছু ব্যবহার করা হয়, কিনারা রক্ষার জন্য।
বিভিন্ন বছরের বন্যার সময়ের ডাটা এনালাইসিস করে এটা বের করা হয় যে, আগামী ১০০ বছরের প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি সাগরে যেতে পারে পদ্মা দিয়ে। (এই যে পদ্মার পানি প্রবাহ হয় এর ২০ সেকেন্ডের পানি যদি আটকানো যায় তাহলে বৃহত্তর ঢাকা শহরের এক কোটি ৬০ লাখ লোকের এক দিনের খাওয়ার পানি হবে।
এই যে এত পানি পার হয়ে সাগরে যায় পদ্মা দিয়ে, এটা পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রথম আমাজান। পদ্মা হলো দুই নম্বর।
এই পানিটা নিতে হবে ব্রিজের নিচ দিয়ে। সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে যেন পানি সেতুর নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে যেতে পারে। এই পানি কোনোভাবে যদি আটকা পড়ে একইসাথে বন্যা হবে আপস্ট্রিমে (নদীর পশ্চিম-উত্তর দিকে) এবং একই সাথে এই পানি ব্রিজের ওপর অনেক বেশি প্রেশার বা ধাক্কা দেবে। ফলাফল হিসেবে ব্রিজ ফেইল করা খুব স্বাভাবিক হবে।
এগুলো হলো নদীশাসনের চ্যালেঞ্জ।
পৃথিবীর খুব কম ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা এ কাজটি করতে পারে। পদ্মা ব্রিজের নদীশাসনের কাজের জন্য যখন টেন্ডার চাওয়া হয়, তখন মাত্র ৩টা কোম্পানি টেন্ডার জমা দেয়। ২০১৪ সালের জুলাইতে এই টেন্ডার পায় সিনোহাইড্রো। এই কাজের মধ্যে চলছে নদী ড্রেজিং করা। ড্রেজিং করা মানে হল, তলদেশের কাদামাটি তুলে এনে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলা।
যাতে পানির গতিপথে বাধা কম থাকে। যাতে বেশি পরিমাণ (বেশি ভলিউম এর পানি) পানি যেতে পারে। এতে কিনারে পানির ধাক্কা কিছুটা কমবে বলে আশা করা যায়। মাওয়া প্রান্তে ড্রেজিং ১০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। আর জাজিরা প্রান্তে ড্রেজিং করা ৪০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার।
এই নদীতে ড্রেজিং করতে হচ্ছে ১০০ ফুটের বেশি। পানির নিচে। আগেই হিসাব করা হয়েছে, নদীর পাড় পানির নিচে কেমন ঢালু হবে। সে অনুসারে নদীর পাড়ের মাটি কাটা হয়েছে। সে জন্য স্পেশাল ড্রেজার ব্যবহার করতে হয়।
যেটা জিপিএস কন্ট্রোলড, পানির নিচের মাটি নিজেই হিসাব করে কাটতে কাটতে যায়।
নদীশাসনের আর একটা অংশ হিসেবে চলছে নদীর কিনারার দিকে পাথর, কংক্রিট ব্লক আর জিও ব্যাগ ফেলা। মাওয়া প্রান্তে পাথর প্রয়োজন ৮.৫ লাখ টন আর জাজিরা প্রান্তে পাথর ফেলা হবে ৩০ লাখ টন। ৮০০ কেজি ওজনের জিও ব্যাগ ফেলা হবে ৩,৯০৭,৫০০ টি। ১২৫ কেজি ওজনের জিও ব্যাগ ফেলা হবে ১৭,২৬৭,৫০০ টি।
টোটাল সিমেন্ট কংক্রিট ব্লকের সংখ্যা ১৩,৩০১,২৪৮।
মাওয়া প্রান্তে নদীশাসনের কাজ ১.৬ কিমি জুড়ে। আর জাজিরা প্রান্তে ১২.৪ কিমি। জাজিরা প্রান্তে এত বেশি কাজ হওয়ার কারণটা বাংলাদেশের ম্যাপ দেখলেই বোঝা যায়। কারণটা হল, পানিটা উত্তর পশ্চিম থেকে ভীষণ বেগে এসে বেশি ধাক্কা দেয় জাজিরার পাড়ে।
এখানে ধাক্কা খেয়েই পানিটা দক্ষিণ -পূর্বে যায়। আবার মাওয়া সাইটে মাটির ধরন কিছুটা ক্লে বা এঁটেল মাটি। দক্ষিণ দিকে জাজিরার সাইটে ক্লে নেই। সেখানে পলি, বালু এবং বেলে-দোআঁশ মাটি। স্রোত বেশি এলে এটা ক্ষয় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
তাই এই নদীশাসন করা হয়েছে জাজিরার সাইটে সাড়ে ১০ কিলোমিটারের মতো। আর মাওয়া সাইটে মাত্র দেড় কিলোমিটার। ২০১৬ সালে মাওয়া সাইটে অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ ভাঙন দেখা যায়। তখন আরো কিছু বেশি কাজ করা হয়।নদীশাসন ব্যাপারটি খুবই দুরূহ।
কারণ নদীতে স্কাওয়ার (মাটি ধুয়ে যাওয়া) এত গভীরে যেতে পারে যে হয়তো ওপরের দিকে কিছু প্রটেকশন দেয়া হল। দেখা গেল নিচ থেকে মাটি ধুয়ে চলে গেছে। তখন ওপর থেকে পাড় ভেঙে পড়ে যাবে। কারণ নিচে কোন সাপোর্ট নেই, সাপোর্টের মাটি ধুয়ে চলে গেছে পুরোটাই। এজন্য অনেক নিচে থেকে পাথর, কংক্রিট ব্লক আর কিছুটা নতুন প্রযুক্তির জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে।
তবে পদ্মার মত একটা রাক্ষুসী নদী যে কিনা ৬৫ মিটার স্কাওয়ার করে ফেলে, তাকে কতটা শাসন করা যায়, বা শাসন করে কী বা কতটুকু লাভ হয়? তবে এজন্য চেষ্টা থামিয়ে দেয়া যাবে না।
নদীশাসন কাজটা হয়ত এখন সব সময়ের জন্যই চালিয়ে যেতে হবে। কন্ট্রাক্ট রিনিউ করা হবে নতুবা নতুন টেন্ডার দিতে হবে। না হলে এই ব্রিজ টেকানো কঠিন। প্রতিটা স্ট্রাকচারের টেক কেয়ার করতে হয়।
নতুবা টেকে না। কোথাও অনেক আগে পড়েছিলাম বাংলাদেশের কাছে জাতীয় সংসদ হল গরীবের হাতি পোষার মতো। এর রক্ষণাবেক্ষণে অনেক খরচ হয়। দেশে এখন নতুন হাতি আসছে! যাই হোক, এগুলোই প্রমাণ করে দেশ এখন আর অত গরিব নাই!
এবার আসি কিছু পিছনের ঘটনায়। এই প্রজেক্টের শুরুতে একটা গবেষণা রিপোর্ট দেওয়া হয় ২০০০ সালে।
পুরো প্রজেক্টটার দ্বিতীয় রিপোর্ট দেওয়া হয় ২০০৫ সালে। এই দুটি ছিল ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি। খুব সহজ ভাষায় বলা যায়, যত টাকা এর পিছে ঢালা হবে, সেটা কতটা লাভজনক, বা আদৌ লাভজনক কিনা, সেই হিসাব করা। বা কোথায় কোন জায়গায় কিভাবে করলে সবচেয়ে কম টাকায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। এই স্ট্যাডিতে পদ্মা সেতু পরিকল্পনার সময় দুটি জায়গায় প্রাথমিক সমীক্ষা চালানো হয়েছিল; পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, আরেকটা হলো মাওয়া-জাজিরা।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছিল, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো নদীটা ক্রস করা। যাতে যানবাহন নদীর ওপর অথবা নিচ দিয়ে যেতে পারে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রথমে স্টাডি করল সেতু ও টানেল নিয়ে। দেখা গেল যে বিনিয়োগের দিক থেকে টানেলে অনেক বেশি খরচ। তখন টানেল বাদ গেল, নদী পার হওয়ার জন্য থাকলো সেতু।
২০০১ সাল থেকে শুরু হলো জাইকার অর্থায়নে ফিজিবিলিটিজ স্টাডি। আবার শুরু হল নতুন করে সাইট সিলেকশন। গোয়ালন্দ থেকে শুরু করে চাঁদপুর পর্যন্ত স্টাডি করে দেখা গেল মাওয়া-জাজিরা সাইটই সবচেয়ে ভালো।
ফিজিবিলিটিজ স্টাডিতে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করতে হয়, একটা হলো, কোন দিক দিয়ে গেলে বেশি যানবাহন আকৃষ্ট হবে, মানে ঠিক কোন জায়গায় রাস্তাটা মানুষের সবচেয়ে বেশি দরকার বা বেশি সংখ্যক মানুষের দরকার। দ্বিতীয়টা হলো, নদীর গতিপথ কোথায় তুলনামূলকভাবে কম পরিবর্তনশীল।
পদ্মা কোনো কোনো বছর দু’এক কিলোমিটার সরে যেতে পারে। এ জন্য সাইট নির্বাচন করতে হলে দেখতে হয়েছে কোনটা বহুদিন ধরে স্থায়ীভাবে রয়েছে। মানে নদীটা বহুদিন ধরে একই জায়গায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও দেখা গেল মাওয়া-জাজিরাই উপযুক্ত স্থান।
পুরো প্রজেক্টটা দুই ভাগে বিভক্ত।
ফেজ ১: প্রজেক্ট ডিজাইন থেকে টেন্ডার দেয়া পর্যন্ত। ফেজ ২: কনস্ট্রাকসন।
ফেজ ১, মানে এই পদ্মা ব্রিজ ডিজাইনিং এর কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালে। পদ্মা ব্রিজের ডিটেলড ডিজাইন করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে টিম গঠন করা হয়। যার প্রধান ছিল AECOM নামের প্রতিষ্ঠান।
টিমে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছিল।
বাংলাদেশ ব্রিজ অথোরিটি একটা প্যানেল গঠন করে, ৫ জন জাতীয় ও ৫ জন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। এই প্যানেলের কাজ ছিল একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর পদ্মা ব্রিজের ডিজাইন রিভিউ করা।
BS 5400 কোড উইজ করা হয়েছে ডিজাইন করার জন্য। কারণ এটার লোড এবং অন্যান্য জিনিস বাংলাদেশের ট্রাফিক কন্ডিশনের সাথে মিলে।
ব্রিজ ডিজাইন করার সময় একটা শিপিং স্টাডি করা হয়। স্টাডিটা এমন যে ব্রিজের নিচে কতটুকু জায়গা থাকলে বাংলাদেশে চলাচল করে এমন সব জাহাজ ব্রিজের নিচ দিয়ে পার হয়ে যেতে পারবে। বিআইডাব্লিউটিএ যে রিপোর্ট দেয়, তাতে বলা হয়, বন্যার সময় যে হাইয়েস্ট রেকর্ড উচ্চতা পর্যন্ত পানি উঠেছিল, সেখান থেকে ১৮.৩ মিটার (৬০ ফিট) উঁচু হতে হবে মিনিমাম ৩টা স্প্যানকে। কিন্তু এখানেও ঝামেলা ছিল। পদ্মা কখনো স্রোতের সাথে তলদেশ থেকে বিশাল পরিমাণ মাটি নিয়ে চলে যায়।
আবার কখনো স্রোতের সাথে এসে অনেক পলি জমা হয়। কখনো পাড় ভেঙে নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলে। দেখা গেল ব্রিজ এক জায়গায় থেকে গেল, নদী ভেঙে পথ পালটে অন্যদিকে চলে গেল। ফলাফল হিসেবে ব্রিজ বানানোটা প্রায় বৃথা গেল।
আবার নদীর মাঝে মাঝে হঠাৎ চর জেগে ওঠে।
দেখা গেল, জাহাজ যাওয়ার জন্য যে তিনটা স্প্যান ৬০ ফিট উঁচু করে বানানো হল, সেখানে চর জেগে উঠলো, জাহাজ যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। কারণ অন্য সব স্প্যান এত উঁচু না। তাদের নিচ দিয়ে জাহাজ যাওয়া সম্ভব না। এজন্য ঠিক কোন জায়গায় আগামী ১০০ বছর (পদ্মা ব্রিজের ডিজাইন লাইফ) পর্যন্ত জাহাজ যাওয়ার মত উঁচুতে স্প্যান দিলে, সেটা টিকে থাকবে, তার নিচে চর জেগে উঠবে না, জাহাজ যেতে পারবে, ব্যাপারটা গেস করা অনেক ক্রিটিক্যাল ছিল। এজন্য পরে সিধান্ত নেয়া হয় যে, জাহাজ যাওয়ার মত উঁচু স্প্যান এর সংখ্যা বাড়ানো হবে।
নদীর মাঝের মোটামুটি ৪.৮ কিমি জুড়ে সব স্প্যানই যথেষ্ট উঁচু বানানো হবে যাতে এদের যে কোনটার নিচ দিয়েই জাহাজ যেতে পারে। আবার, পদ্মা নদী একটা ভীষণ খরস্রোতা নদী। তার সাথে নদীর তলদেশে স্কাওয়ার হওয়ার প্রবণতা এবং একইসাথে একটা ভূমিকম্প হওয়ার মত জায়গায় এর অবস্থান হওয়ায়, ব্রিজটার ডিজাইন করার সময় এবং তৈরির সময়ও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন হতে হয়েছে।
পদ্মা ব্রিজ ডিজাইনের সময় ভূমিকম্প নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করা হয়। এই কাজটা করেছিল বুয়েট।
দুই লেভেল এর ভূমিকম্প নিয়ে স্ট্যাডি করা হয়।
১. operating level earthquake : এটা ১০০ বছরে ১ বার হওয়ার আশঙ্কা ৬৫ শতাংশ। এটা ঢাকায় বা দেশে যে টুকটাক ভূমিকম্প হয়, তার চেয়ে ভয়ানক তবে পরের লেভেল এর চেয়ে কম ক্ষতিকর।
২. contingency level earthquake : এই ভূমিকম্প খুবই সিভিয়ার লেভেলের। এটা ৪৭৫ বছরে একবার আসে।
ব্রিজের ১০০ বছর ডিজাইন লাইফে এটা হওয়ার আশঙ্কা ২০ শতাংশ।
এসব গবেষণা থেকে উপযুক্ত, কার্যকর ও ভূমিকম্পসহনীয় বিষয়গুলো নিশ্চিত করে ব্রিজ ডিজাইন করা হয়। এই হল পদ্মা ব্রিজ। পদ্মা বহুমুখী সেতু।