শত চেষ্টা, মানব পাচারবিরোধী কঠোর আইন, সরকার ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ- কোনো কিছুই থামাতে পারছে না অবৈধ বিদেশযাত্রা। বন্ধ করা যাচ্ছে না সাগর, মরুভূমি বা বরফের মধ্যে জমে মৃত্যুর মিছিল। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধ অভিবাসীদের এ অনিরাপদ ও অবৈধ যাত্রা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। গত নভেম্বর এর প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন কিছু সংগঠনের জোট বাংলাদশে সভিলি সোসাইটি ফর মাইগ্রন্টেস (BCSM) এর কাছে খবর আসে ক্রোয়েশিয়া-বসনিয়া সীমান্ত অঞ্চলে কয়েক শত বাংলাদেশি আটকে পড়েছে অবৈধভাবে ইউরোপ পাড়ি দিতে দিয়ে। জার্মান রেডিও ডয়েচে ওয়েলে সর্বপ্রথম এসব অভিবাসীদের দুর্দশার কথা জানিয়ে বলে যে, গত বেশ কয়েক মাস ধরে ৫ শতাধিক অভিবাসী পরিত্যাক্ত ভবন এমনকি জঙ্গলে বাস করছনে।
আরো পড়ুন : শহীদ মিনারে সর্বোচ্চ ৫ জন একসাথে শ্রদ্ধা জানাতে পারবে
ডিডব্লিউ এর মতে এসব আটকে পড়া বাংলাদেশিরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের পাচারকারী চক্রের সাথে সংশ্লিষ্ট একদল বাংলাদেশি মানব পাচারকারী দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিলেন। তাদের প্রত্যেকে ইউরোপে পৌঁছানোর জন্য গড়ে ১০ থেকে ১৪ হাজার ইউএস ডলার খরচ করেছেন। বিভিন্ন রুটে এসব অভিবাসীরা ভূমধ্যসাগর হয়ে বসনিয়াতে এসে পৌঁছান। এরপর তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়ায় প্রবেশের জন্য কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। প্রতিবারই ক্রোয়েশিয়ান সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করে অর্থ, মোবাইল ফোন, শীতের পোশাকসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে তাদের আবার বসনিয়াতে ফেরত পাঠায়। বসনিয়ায় বাংলাদেশের কোন কূটনৈতিক প্রতিনিধি না থাকায় নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশি দূতাবাসই এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল কোনো হস্তক্ষেপ বা সহায়তা করার।
সংকটময় ও শীতের দিনগুলোতে তাদের সুরক্ষায় অন্ন, আশ্রয় এবং চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের জন্য বসনিয়া সরকার, বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাসমূহ বিশেষত রেডক্রস, আইএলও, আইওএমকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য বিসিএসএম আহ্বান জানায়। বিসিএসএম আশঙ্কা করে যে, শীত শুরু হওয়ার সাথে সাথে এসব দুর্গম জঙ্গলে খোলা আকাশের নীচে অস্থায়ী তাবু থেকে তাদের উদ্ধার করার জন্য তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা না নেয়া হলে অনেকেই মৃত্যুবরণ করবেন। ডিডব্লিউ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটকে পড়া কয়েকজন বাংলাদেশি দেশে ফিরতে ইচ্ছুক ছিলেন কিন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠরা তা করতে রাজি হননি। বিসিএসএম পরিস্থিতি ট্র্যাজেডিকে পরিণত হওয়ার আগে বসনিয়া সরকারকে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা প্রদানেরও দাবি জানায়। একইসাথে, বাংলাদেশ সরকারকেও এই বাংলাদেশিদের আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার এবং মানবপাচার ও মানব চোরাকারবারসহ বিভিন্ন ধরণের অনিরাপদ অভিবাসন বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানায়। পরে অবশ্য আটকে পড়া বাংলাদেশিদের সম্পর্কে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জানা যায়নি তাদের পরিণতি কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত।
আরো পড়ুন : ভোজ্যতেলের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে কাজ করছে মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি
এই ঘটনা নতুন কিছু নয় আমাদের জন্য। রঙিন জীবনের স্বপ্ন আর দালালদের খপ্পড়ে পড়ে প্রতি বছর এই মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। খালি হচ্ছে মায়ের বুক। স্বামী হারা, বাবা হারা হচ্ছেন কতজন তা আমরা জানি না। অনেকের লাশ বা দাফনের খবরও আমরা জানি না। সেই সাথে মৃত্যু হচ্ছে হাজারও স্বাপ্নের। শোনা যায় ইউরোপের দেশগুলোর বিভিন্ন বন-জঙ্গলে ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে এখন মৃত্যু আর লাশের স্তুপ।
কয়েক মাস আগের এক সকালে ঘুম ভাঙে এক ভদ্রমহিলার ফোনে। কথা বলতে চান। সম্মতি দিতেই তিনি জানালেন বিপদে পড়ে ফোন করেছেন। এক ব্যক্তিকে (দালাল) ৬ লাখ টাকা আর স্বামী স্ত্রী দুজনের পাসপোর্ট দিয়েছিলেন কানাডা যাওয়ার জন্য। এখন সে লাপাত্তা। কানাডা যাওয়ার প্রতারণা নিয়ে তার মাত্র কদিন আগে আমি সতর্ক করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছি। সেখানে লিখেছিলাম আমরা শুধু প্রতারণা করি না, প্রতারিত হতেও ভালোবাসি। ১০ দিন যেতে না যেতেই সেই কেস! আমার বুঝতে বাকি নেই কি ঘটেছে। শুধু বললাম, এটা অন্যায়; এভাবে কেউ কাউকে টাকা দেয়! মহিলা প্রায় কেঁদে দিয়ে বললেন, সব সঞ্চয় আর ধারদেনা করে টাকা দিয়েছিলাম। এখন তো আর কোনো উপায় দেখছি না। তিনি ডিগ্রি পাশ, স্বামী গ্রাফিক্সের কাজ করেন। কানাডায় তাদের পিআর পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপরও খোঁজ খবর না করে কেন টাকা পাসপোর্ট দিলেন জানতে চাইলে বলেন, কানাডায় বসে কলকাঠি নাড়েন একজন বাংলাদেশি। তিনি জানিয়েছিলেন বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের ভিসা হয়ে গেছে, ভিসার কপিও মহিলা দেখেছেন, তারপর টাকা দিয়েছেন। বুঝলাম তিনি ফাঁদে ভালোমতো আটকেছিলেন। তিনি শুধু একা নন, আরও অন্তত বিশ জন এই প্রতারণার শিকার বলে তিনি জানতে পেরেছেন। আমার কাজ হলো টাকা উদ্ধার করে দিতে সহায়তা করা। আমার নাম্বার তিনি পেয়েছেন অন্য আর এক ভিক্টিমের কাছ থেকে। তিনি কিভাবে পেয়েছেন তা জানেন না। প্রায় ২৫ বছর ধরে দেশের বাইরে যাতায়াত করি। এখনো অনেক দেশের ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় হাত পা কাপে। আর উনারা এতোগুলো টাকা, পাসপোর্ট দিলেন কোন যাচাই না করে! খারাপও লাগছে উনাদের জন্য। সেফ মাইগ্রেশন নিয়ে বিশ বছরের বেশি কাজ করি। অস্ট্রেলিয়ায় পিআর পাওয়ার বিষয়ে আমরা সাহায্য করার চেষ্টা করি। এর নাড়ি-নক্ষত্র আমাদের জানা। উনার কাছে যা যা তথ্য, ফোন নাম্বার, কাগজ আছে সব নিয়ে বিকেলে আসতে বলি। এর মধ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একটা এজেন্সির সাথে আলাপ করে পুরো ঘটনা বলে সহায়তা চাইলাম যারা এর আগেও সহায়তা করেছেন। এমন কত শত প্রতারণার ঘটনা যে প্রতিদিন ঘটছে তার খবর আমরা ক'জন জানি!
আরো পড়ুন : কারাগারে নারীসঙ্গ: কে কত টাকা ঘুষ নিয়েছেন?
সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি নিজেদের সতর্ক হওয়া খুব জরুরী। এক্ষেত্রে সচেতন হলে আপনারাই আপনাদের স্বজনদের মৃত্যু ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে পারেন। জীবনের ঝুঁকি নেবেন না, দালালের খপ্পড়ে পড়ে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি দেবেন না। প্রয়োজনে দেশে কিছু করার চেষ্টা করুন যে টাকা খরচ করে বিদেশে যাচ্ছিলেন। আত্মীয়-বন্ধু কাউকে অবৈধভাবে ইউরোপের দেশে যাবার জন্য উৎসাহিত করবেন না।
বিদেশে যান, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ যান। কিন্তু দেখে শুনে বৈধভাবে যান। আর বোকামি কইরেন না! বোকামি করবেন না। এতে আপনি শুধু নন আপনার পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, নষ্ট হয় দেশের ভাবমূর্তি।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, মানবধিকার ও নিরাপদ অভিবাসনকর্মী।
সূত্র: বিডি প্রতিদিন